আজ, বৃহস্পতিবার | ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ



অন্তর্বর্তী সরকারের সব কাজ বৈধ, মেয়াদ অনির্দিষ্ট: জারি হচ্ছে অধ্যাদেশ

অন্তর্বর্তী সরকারের সব কাজ বৈধ, মেয়াদ অনির্দিষ্ট: জারি হচ্ছে অধ্যাদেশ
ডেক্স নিউজ :
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক। ছবি: সংগৃহীত

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারকে আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে ‘অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এর খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। অধ্যাদেশটি জারি হলে আদালতে বৈধতার প্রশ্ন তুলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে অবৈধ বা বাতিল করা যাবে না। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত নতুন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নেয়ার দিন পর্যন্ত হবে বর্তমান সরকারের মেয়াদ।

এই সরকারের কোনো কার্যক্রমের বৈধতা সম্পর্কে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টসহ অন্য কোনো আদালত বা কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই কোনো প্রশ্ন উত্থাপন বা তা অবৈধ বা বাতিল করতে পারবে না, এমন কথাও বলা হয়েছে এতে।

বলা হয়েছে, এ সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন বা মামলাও করা যাবে না।

নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ, জরুরি অবস্থা ঘোষণায় প্রধান উপদেষ্টার পরামর্শ নেয়াসহ সার্বিক বিষয়কে আইনি ভিত্তি নিয়ে এই অধ্যাদেশের খসড়া করা হয়েছে। খসড়ার শিরোনাম করা হয়েছে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অধ্যাদেশ, ২০২৪’।

গত ১৯ সেপ্টেম্বর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এই খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। সেটি এখন গেজেট প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।

শুক্রবার মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদ বলেন, স্বাভাবিকভাবেই পরবর্তী নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণের আগ পর্যন্ত বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ কার্যকর থাকবে। অধ্যাদেশটি যখন জারি হবে তখনই আপনারা জানতে পারবেন।

তিনি বলেন, ‘নানা ধরনের দিক, যা যা রয়েছে তা চিন্তাভাবনা করে তো অধ্যাদেশের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। আইন উপদেষ্টা মহোদয় এখন দেশের বাইরে রয়েছেন। উপদেষ্টা দেশে এলে কথা বলে নেবেন।’

সরকারি চাকরিতে কোটার বিরোধিতা করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সরকার পতনের ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনে রূপ নিলে গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর তিন দিন পর ৮ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে শপথ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। তার আগেই ভেঙে দেয়া হয় সংসদ।

এই সরকারের মেয়াদ কতদিন হবে, সে বিষয়ে এখনও কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, এর মধ্যে আছে সাংবিধানিক সংস্কারও।

সংবিধানে বলা আছে, সংসদ ভেঙে দিলে ৯০ দিনের মধ্যে ভোট হতে হবে, আর কোনো দৈব দুর্বিপাকে সেটা করা না গেলে পরের ৯০ দিনেই হতে হবে নির্বাচন।

তবে সরকার শুরু থেকেই তার মেয়াদ এবং নির্বাচনের সময়সীমা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য দিচ্ছে না। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচনের আভাস দিয়ে একটি বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে বক্তব্য দিলেও সরকারের তরফে সেটি ‘ব্যক্তিগত বক্তব্য’ বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ২০২৫ সালের শেষে ভোট হতে পারে বলে একটি বক্তব্য দেওয়ার পরে সেটি ‘সরকারের বক্তব্য নয়’ বলে প্রতিক্রিয়া জানান ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন।

দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি অবশ্য এরই মধ্যে দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার দাবি তুলছে, তারা বলছে, সংবিধান সংশোধন বা সংস্কারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচিত সংসদ, সেটিই হবে টেকসই।

 

আরেক আলোচিত দল জামায়াতে ইসলামী শুরুতে ‘আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন’ এমন একটি অবস্থান নিলেও এখন ‘দ্রুত সংস্কার করে নির্বাচন’ দেয়ার কথা বলছে।

 

অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ কী হবে, তা-ও ঠিক করে দেওয়া হয়েছে চূড়ান্ত করা অধ্যাদেশে। সেখানে এ-সংক্রান্ত ধারায় বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার একটি অস্থায়ী বা সাময়িক সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। সরকারি কর্মচারীদের সহায়তায় সরকার কাজ করবে। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠানে এবং সংবিধান বা অন্য কোনো আইন দিয়ে নির্ধারিত দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে সাহায্য ও সহায়তা দেবে।

‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক প্রণীত অধ্যাদেশ ও কার্যক্রমের বৈধতা’ ধারায় বলা হয়েছে, ‘সংবিধান এবং আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়া এবং নতুন সংসদ গঠিত হইবার পর প্রধানমন্ত্রী যে তারিখে তাঁহার পদের কার্যভার গ্রহণ করিবেন, সেই তারিখের (উভয় দিনসহ) মধ্যবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক প্রয়োগকৃত সকল ক্ষমতা, প্রণীত সকল অধ্যাদেশ, বিধিমালা, প্রবিধানমালা, জারিকৃত প্রজ্ঞাপন, প্রদত্ত আদেশ, কৃত কার্য, গৃহীত ব্যবস্থা আইনানুযায়ী যথাযথভাবে প্রয়োগকৃত, প্রণীত, জারীকৃত, প্রদত্ত, কৃত এবং গৃহীত হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে এবং বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টসহ অন্য কোনো আদালত বা কর্তৃপক্ষ ইহাদের বৈধতা সম্পর্কে কোনোভাবেই কোনো প্রশ্ন উত্থাপন কিংবা ইহাদেরকে অবৈধ বা বাতিল করিতে পারিবে না।’

 

এতে আরও বলা হয়, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অধ্যাদেশের অধীন গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন, প্রধান উপদেষ্টা বা কোনো উপদেষ্টাদের নিয়োগ নিয়ে ত্রুটি থাকলে সে জন্য কোনো কাজ অবৈধ হবে না, এ জন্য কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন বা মামলা দায়েরও করা যাবে না।’

 

নতুন অধ্যাদেশের খসড়ায় রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা প্রসঙ্গে বলা হয়, ‘বিদ্যমান অন্যান্য আইনে যা কিছুই বলা থাকুক না কেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময় প্রধান উপদেষ্টার পরামর্শ নিয়ে রাষ্ট্রপতিকে কাজ করতে হবে। জরুরি অবস্থা ঘোষণার বৈধতার জন্য প্রধান উপদেষ্টার পরামর্শ নিতে হবে।’

 

কারা হবেন উপদেষ্টা, সুযোগ-সুবিধা কী

 

সংবিধান অনুযায়ী, কারও বয়স ২৫ বছর পূর্ণ না হলে তিনি সংসদ সংসদ হতে পারেন না। সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়। মন্ত্রিসভায় এক-দশমাংশ পদে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের মধ্য থেকে মনোনীত করা যায়। অর্থাৎ তাঁদের বয়সও কমপক্ষে ২৫ বছর হতে হবে।

 

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার জন্য বয়স কমপক্ষে ২৫ হতে হবে। এ নিয়ে অধ্যাদেশের খসড়ায় বলা হয়েছে, ২৫ বছরের কম বয়সী কেউ প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা পদে নিয়োগ পাবেন না। কোনো আদালত অপ্রকৃতিস্থ বলে ঘোষণা করলে, দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার পর দায় থেকে অব্যাহতি না পেলে, কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করলে এসব পদে নিয়োগ পাওয়া যাবে না। এ ছাড়া নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে এবং মুক্তি পাওয়ার পর পাঁচ বছর পার না হলেও এসব পদে নিয়োগ পাওয়া যাবে না।

 

এ ছাড়া ‘ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না’—এ বিষয়ে সম্মত না হলেও প্রধান উপদেষ্টা বা উপদেষ্টা পদে নিয়োগ পাওয়া যাবে না বলে অধ্যাদেশের খসড়ায় বলা হয়েছে।

 

রাষ্ট্রপতির কাছে লেখা ও স্বাক্ষরযুক্ত পত্রের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টারা পদত্যাগ করতে পারবেন। পদত্যাগ, মৃত্যু বা অন্য কোনো কারণে প্রধান উপদেষ্টার পদ শূন্য হলে উপদেষ্টাদের মধ্য থেকে একজনকে রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবেন।

 

নতুন অধ্যাদেশের খসড়া অনুযায়ী, প্রধান উপদেষ্টা প্রধানমন্ত্রীর এবং উপদেষ্টারা মন্ত্রীর পদমর্যাদা, পারিশ্রমিক ও সুযোগ-সুবিধা পাবেন। প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার সদস্যরা কী কী সুযোগ-সুবিধা পাবেন, সে বিষয়ে আইন রয়েছে।

 

কবে নাগাদ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অধ্যাদেশ জারি হতে পারে, সে বিষয়ে সরকারের দুজন উপদেষ্টার সঙ্গে যোগাযোগ করেও জানা যায়নি।

 

তবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন দেওয়ার পর আমরা বিভিন্ন বিষয় পরীক্ষা করেছি। সরকারের পক্ষ থেকে আর কোনো নির্দেশনা না এলে খসড়াটি চূড়ান্ত অবস্থায় রয়েছে বলে আমরা মনে করছি।’