আজ, শুক্রবার | ১০ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৭শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ



অর্থনীতিবিদেরা ব্যাংকে লেনদেন কমে যাওয়া অর্থনীতির সার্বিক অবস্থার প্রতিফলন বলে মনে করছেন

                              ছবি সংগ্রহীত

দেশে এক বছরের বেশি সময় ধরে চলছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এই সূচক ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এর প্রভাব যে জনজীবনে অনুভূত হচ্ছে, তার প্রমাণ সরকারি পরিসংখ্যানেই পাওয়া যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ লেনদেনসংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদনে জানা গেছে, ফেব্রুয়ারিতে দেশে ব্যাংকিং লেনদেন কমেছে। এই পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ নানা কারণে দেশের অর্থনীতিতে শ্লথগতি দেখা যাচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ; সেই ধারা থেকে অর্থনীতি এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি।

২০২৪ সালের জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংকে চেকের মাধ্যমে লেনদেন কমেছে ১২ শতাংশের বেশি। একই সময়ে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের (ইএফটি) মাধ্যমে লেনদেন কমেছে ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন কমেছে ৩৬ শতাংশের বেশি; ডেবিট কার্ডে ১ দশমিক ৫১ শতাংশ ও ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে কমেছে ২ দশমিক ৪৮ শতাংশ। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে (এমএফএস) লেনদেন কিছুটা বাড়লেও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের লেনদেন ৬ শতাংশের বেশি কমেছে। এমএফএসে লেনদেন বেড়েছে দশমিক ৪৯ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি লেনদেন কমেছে ক্রেডিট কার্ডে। জানুয়ারিতে এর মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা; ফেব্রুয়ারিতে এই কার্ডভিত্তিক লেনদেন নেমে আসে ১ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকায়। অর্থাৎ লেনদেন কমেছে প্রায় ৩৭ শতাংশ—লেনদেন কমেছে ডেবিট কার্ডেও।

লেনদেনের এই ঋণাত্মক চিত্র অর্থনীতির শ্লথগতির পরিচায়ক বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা। বিশেষ করে দেশে এক বছরের বেশি সময় ধরে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, তার জেরে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। তার প্রভাব পড়ছে লেনদেনে।

বাংলাদেশের অবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের মতো নয়। ফলে ব্যাংক লেনদেন দিয়ে অর্থনীতির পুরো চিত্র পাওয়া যাবে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তবে তিনি মনে করেন, বর্তমানে অর্থনীতির যে চালচিত্র, তার সঙ্গে ব্যাংক লেনদেন কমে যাওয়ার পরিসংখ্যান মিলে যায়।

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, দেশে অনেক দিন ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এ বাস্তবতায় অনেকে সঞ্চয়পত্র ভেঙে ফেলছেন; ব্যাংক থেকেও আমানত তুলে নিচ্ছেন। মূল্যস্ফীতির রাশ টানতে সুদহার বাড়ানো হয়েছে। ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়েছে; স্বাভাবিকভাবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে তার প্রভাব পড়ছে। অর্থনীতির সংগঠিত ক্ষেত্রে তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে, যেমন শিল্প ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে।

মানুষের হাতে ব্যয় করার মতো অর্থ থাকলে সাধারণত শহর অনেক রাত জেগে থাকে। সম্প্রতি ব্লুমবার্গে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লন্ডনের মতো শহর একসময় সারা রাত জেগে থাকলেও এখন আর সে বাস্তবতা নেই। শহরের যেসব এলাকা নাইট লাইফের জন্য বিখ্যাত ছিল, সেসব এলাকার দোকানপাট বেশ তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোভিডের পর থেকেই এই প্রবণতা শুরু হয়েছে। যার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, মানুষের হাতে ব্যয়যোগ্য অর্থের পরিমাণ কমে যাওয়া।

ব্লুমবার্গের সেই সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢাকার পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকে বলছেন, ঢাকার যেসব এলাকা একসময় সারা রাত জেগে থাকত, যেমন মিরপুর-১০, পল্টন, নীলক্ষেত—সেগুলো এখন আর সারা রাত জেগে থাকছে না। এর সঙ্গে মানুষের হাতে ব্যয়যোগ্য অর্থ কমে যাওয়ার সম্পর্ক আছে বলেই ধারণা করা যায়।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘দেশে এক বছরের বেশি সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। তার রাশ টেনে ধরতে সুদহার বাড়ানো হয়েছে, যাতে মানুষ বেশি ব্যয় না করে। সেটা করতে গেলে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব পড়বেই। সম্ভবত, আমরা এখন সেটাই দেখতে পাচ্ছি।’ তিনি আরও বলেন, দেশের অর্থনীতি এখন সংকটের মধ্যে আছে। এই পরিস্থিতিতে প্রবৃদ্ধি নয়, বরং স্থিতিশীলতা মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।

এদিকে সুদহার বৃদ্ধির সঙ্গে ডলার–সংকট মোকাবিলায় এখনো আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। মোট আমদানির প্রায় ৭৫ শতাংশ শিল্পের যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও মধ্যবর্তী পণ্য; সে কারণে সুদহার বাড়ানোর প্রভাব প্রবৃদ্ধিতে পড়ছে। এতে বিনিয়োগ ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ব্যাহত হচ্ছে; প্রভাব পড়ছে রাজস্ব আয়ে। রাজস্ব আয় কমে যাওয়ায় সরকারের ঋণ বাড়ছে, উন্নয়ন প্রকল্প ঠিকমতো বাস্তবায়িত হচ্ছে না। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাস জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ৩১ দশমিক ১৭ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। অর্থবছরের আট মাস বিবেচনায় এটি গত ১০ বছরের মধ্যে এডিপির সর্বনিম্ন বাস্তবায়নের হার।

ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কমে যাওয়ার ফলে রাজস্ব আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ১৭ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা।