আজ, শনিবার | ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ



র‍্যাবের তদন্ত কমিটি : অর্ধশতাধিক নারীকে ধর্ষণ করেছে ওসি প্রদীপ

শহর সংবাদদাতাঃ

মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ হত্যা মামলায় কারাগারে থাকা বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ মাদকের তকমা দিয়ে টেকনাফের অল্পবয়সি তরুণীদের বাড়ি থেকে তুলে এনে থানায় নিয়মিত ধর্ষণের উৎসব করত। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ ছাড়াও র‍্যাবের তদন্তে উঠে এসেছে ওসি প্রদীপের ধর্ষণ-সম্পৃক্ততার এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। ভুক্তভোগী পরিবার ও স্থানীয়দের দাবি, প্রদীপ ও তার সহযোগীরা ৫০ জনের বেশি নারীকে ইয়াবা কারবারি বলে বাড়ি থেকে তুলে এনে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ করেছে। সিনহা হত্যা-পরবর্তী টেকনাফে প্রদীপ আমলের কথিত বন্দুকযুদ্ধে ১৬১ জনকে হত্যা ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা চাঁদা আদায়ের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশের পর দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ওই সময় ভুক্তভোগীদের কেউ মামলা না করায় ধামাচাপা পড়ে প্রদীপের বিরুদ্ধে সিরিয়াল ধর্ষণের অভিযোগগুলো।
টেকনাফ নাজিরপাড়ার ধর্ষণের শিকার এক গৃহবধূ অভিযোগ করে জানান, স্বামীকে ধরে নিয়ে গিয়ে ৪৫ লাখ টাকা দাবি করে  ওসি প্রদীপ। নগদ ৩ লাখ টাকা, ব্যবহারের স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে স্বামীকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় যান তিনি। ‘স্বামীকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে তিন দিন আটকে রেখে ওসি প্রদীপসহ কয়েকজন মিলে তাকে টানা ধর্ষণ করে। তিন দিন পর স্বামীকে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে তাকে বাড়ি চলে যেতে বলা হয়। পরদিন তার স্বামীর গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। ওই সময় ধর্ষণের বিষয়ে মুখ খুললে পরিবারের সবাইকে হত্যার হুমকি দেয় ওসি প্রদীপ। যোগ করেন ওই ভুক্তভোগী নারী।
ওসি প্রদীপের ধর্ষণের শিকার হওয়ার অভিযোগ করে টেকনাফের হৃীলার আরেক গৃহবধূ জানান, তার স্বামীর কাছে চাঁদা দাবি করে স্থানীয় সন্ত্রাসী গিয়াস বাহিনীর লোকজন। চাঁদা না দেওয়ায় এক দিন সন্ধ্যায় এসআই মশিউর বাড়িতে এসে তাকে ইয়াবা কারবারি বলে ধরে নিয়ে যায়। পরে অজ্ঞাত স্থানে টানা তিন দিন আটকে রেখে ওসি প্রদীপ ও সন্ত্রাসীরা তাকে ধর্ষণের পর মরিচের গুঁড়ো দিয়ে গোপন স্থানে পাশবিক নির্যাতন চালায়। এরপর ইয়াবা দিয়ে আদালতে চালান করে দেয়। ওই নির্যাতিত পরিবারের আলম নামে এক সদস্যের দাবি, তাদের পরিবারের ৬ নারীই প্রদীপের হাতে একইভাবে ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
উখিয়ার কোর্ট বাজারের নির্যাতিতা এক মেয়ের অভিভাবক জানায়, ২০১৯ সালের শেষের দিকে তার পরিবারের কলেজপড়ুয়া ১৭ বছরের এক তরুণী টেকনাফে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে গেলে প্রেমিকসহ কয়েকজন মিলে তাকে ধর্ষণ করে। ঘটনাক্রমে বিষয়টি ওসি প্রদীপ পর্যন্ত গড়ায়। ওই সময় ধর্ষকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে প্রদীপ নিজেও কয়েক দিন আটকে রেখে একাধিকবার ধর্ষণের পর ইয়াবা দিয়ে ওই তরুণীকে চালান করে দেয়।
অভিযোগ আছে, টেকনাফ হোয়াইক্যং এলাকার আনোয়ার নামে এক ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে গিয়ে অর্ধকোটি টাকা চাঁদা দাবি করে ওসি প্রদীপ। টাকা দিতে না পারায় তিনদিন পর কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে তাকে হত্যা করা হয়। এ বিষয়ে প্রতিকার পেতে নিহতের মেয়ে এবং বোন কক্সবাজার আদালতে যান। খবর পেয়ে ওই দুই নারীকে তুলে নিয়ে যায় ওসি প্রদীপের লোকজন। তাদের থানায় আটকে রেখে টানা পাঁচ দিন গণধর্ষণের পর ইয়াবা দিয়ে চালান দেওয়া হয়।
এদিকে ধামাচাপা পড়ে যাওয়া অসংখ্য নারীর ধর্ষণের অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান করেন এই প্রতিবেদক। ভুক্তভোগী নারীদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বের করা হয় কক্সবাজার জেলা কারাগারের তৎকালীন মেডিকেল রাইটার হাজতি মো. ইউসুফকে। তিনি কারাগারে থাকাকালে প্রদীপের কাছে ধর্ষিত অসংখ্য নারীকে চিকিৎসা দিয়েছেন বলে জানান।
ইউসুফ জানান, ঘটনাক্রমে একটি মিথ্যা মামলায় ফেঁসে গিয়ে দীর্ঘদিন কারাভোগের পর ২০২০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। হাসপাতালের টেকনোলজিস্ট ও চিকিৎসার বিষয়ে অভিজ্ঞতা থাকায় তাকে কারা মেডিকেলের রাইটার হিসেবে দায়িত্ব দেয় কারা কর্তৃপক্ষ। সেই সুবাদে কারাগারে থাকা সব রোগীর তিনি দেখভাল করতেন। তিনি আরও জানান, টেকনাফের ১৬ বছরের এক তরুণী তাকে জানিয়েছিল বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে এসে তাকে থানায় ১৫ দিন আটকে রাখে ওসি প্রদীপ। এ সময়ের মধ্যে একাধিকবার প্রদীপ তাকে ধর্ষণ করে। পরে একইভাবে আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্যও তাকে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের পর প্রত্যেকবার গোপনাঙ্গে মরিচের গুঁড়ো দিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করা হয় তাকে। এ সময় যন্ত্রণায় চিৎকার করলে প্রদীপ ও তার সহযোগীরা উল্লসিত হতো বলে জানায় ওই তরুণী। ধর্ষণ-পরবর্তী সময়ে তাকে ইয়াবা দিয়ে চালান করে দেওয়া হয়েছিল। কারাগারে এসে অসুস্থতার কারণে মৃত্যুর কাছাকাছি চলে গিয়েছিল ওই তরুণী। পরে সদর হাসপাতালে নিয়ে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। তার বুকে-পিঠে অমানসিক নির্যাতনের চিহ্ন ছিল বলে জানান ইউসুফ।
একইভাবে কারাগারে আসা টেকনাফের রঙ্গিখালীর এক তরুণী ইউসুফকে জানিয়েছিল, বাড়ি থেকে তুলে এনে এক মাসের বেশি সময় আটকে রেখে একাধিকবার ধর্ষণ করে ওসি প্রদীপ। পরে মরিচের গুঁড়ো দিয়ে তাকেও মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করা হয়। সর্বশেষ ইয়াবা দিয়ে তাকেও চালান করে দেওয়ার ভয়াবহ বর্ণনা ওই তরুণীর মুখে শুনেছেন ইউসুফ। এভাবে কারাগারে আসা অগণিত নারী চিকিৎসা নিতে এসে প্রদীপের কাছে ধর্ষণের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন ইউসুফ।
ইউসুফের দেওয়া তথ্য মতে, অর্ধশতাধিক তরুণী প্রদীপ কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়েছে জানিয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। অবস্থা জটিল হলে ধর্ষিতাদের পাঠানো হতো কক্সবাজার সদর হাসপাতালে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী দেওয়া হয়েছে তাদের চিকিৎসা। এর বাইরেও অনেকে গর্ভবতী না হওয়ার জন্য চিকিৎসা নিলেও লজ্জায় ধর্ষণের কথা স্বীকার করেনি। ইউসুফ আরও জানান, কারাগারে অন্তত ১৭ জন ধর্ষিতার লোমহর্ষক বর্ণনা এখনও তিনি ভুলতে পারেন না। তারা সবাই প্রদীপের ধর্ষণ-পাশবিকতার শিকার।